এক শ্রাবনের বিকালে...
- স্বপ্ননীল
শ্রাবনের আকাশে ছোপ ছোপ মেঘ জমেছিল সেই সকাল থেকে ।তারপর শ্রাবন মেঘের
অবিরত কান্না।
সেদিনও শ্রাবনের দিন,আকাশে এই রকমই ঘন কালো মেঘ । প্রকৃতির এমন রুপ
সেদিনের আগে কখনও চোখে ধরে নি ।
বিকেল বেলা । আকাশটা মেঘলা ।হালকা ঝড়ো বাতাস বইছে ।আমি আধ-শোয়া অবস্থায়
শ্রীকান্ত,পঙ্কজ উদাসের গান শুনছি.....
আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম........।।
হঠাৎ মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল । মোবাইল স্ক্রীনে সূপর্না । কল রিসিভ করতেই
ও পাশ থেকে সূপর্না বলে চলল, "কোথায় তুমি ? দেখ আকাশটা কত সুন্দর লাগছে
! তুমি তাড়াতাড়ি আমার বাসার সামনে চলে এসো" ।আমার মনটা হঠাৎ করেই যেন
আনন্দে নেচে উঠল ।এমন অভাবনীয় প্রস্তাব কোনভাবেই হাত ছাড়া করা যায় না ।
আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম ।
বাইকটা নিয়ে কালবিলম্ব না করে আমি ওর বাসার সামনে হাজির হলাম ।সূপর্না
বারান্দাতেই দাড়িয়ে ছিল ।আমাকে দেখেই যেভাবে ছিল সেভাবেই এসে আমার বাইকে
চড়ে বসল ।ওর চোখে মুখে চির চেনা চঞ্চলতা ।বলল. "ভালই হলো,তুমি বাইক নিয়ে
এসেছ;চলো আজকে বাইকে করে বৃষ্টিতে ভিজবো" ।
আমি ওকে বললাম, "তা ,কোথায় যাওয়া যায় ?"
ও বলল, "নির্জন কোন যায়গায় নিয়ে চল" ।
আমার মাথায় তড়িৎ বেগে আশ-পাশের যতগুলো র্নিজন জায়গা,বাগান,রাস্তা ছিল সব
এ পাশ থেকে ও পাশে চলে গেল । স্থির করলাম চলনবিলে যাব ।এখান থেকে প্রায়
এক ঘন্টার পথ । আকাশটা ততক্ষনে অন্ধকার হয়ে এসেছে ।আশ-পাশের রাস্তার
মানুষ গুলো যে যেভাবে পারে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে ।আর তারই
মাঝে এক জোড়া বলাকা কালো মেঘের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছি ডানা মেলে
ভালবাসার অমোঘ আকর্ষনে ।
সূর্পনাটাকে আজ কেন জানি অনেক সুন্দর লাগছে,বরাবরের চেয়ে আরো বেশী সুন্দর
। সাদা স্যালোয়র কামিজে এরকম মেঘলা পরিবেশে ওকে স্বর্গ থেকে নেমে আসা পরী
বা তার চেয়ে বেশী কিছু মনে হচ্ছে ।
কিছুক্ষনের মধ্যেই বৃষ্টি নামবে । আকাশটা দারুন তর্জন গর্জন করছে ।মাঝে
মাঝে মেঘের আড়াল থেকে কে বা কারা যেন কর্কশ কন্ঠে আমাদের হুমকি-ধামকি
দিয়ে চলেছে অবিরত আর সেই সাথে বিজলী যোগ করেছে এক অপার্থীব দৃশ্যের ।
সূপর্না আমাকে জাপটে ধরে বসে আছে পেছনে ।ওর মেঘ কালো চুল গুলো অবাধ্য
বাতাসে মাঝে মাঝে আমার মুখের সামনে এসে নাচানাচি করছে ।কন্ঠে চঞ্চলতা আর
বাধ ভাঙা আনন্দের গান । ও আজ বড্ড ছেলেমানুষী করে চলছে,আর তাই হয়ত এত
বেশী সুন্দর লাগছে ওকে ।
অবশেষে চলনবিলের মাঝা-মাঝি এসে গেছি আমরা ।সামনেই বড় ব্রীজটা ।রাস্তার
দু'পাশে লাটিম গাছগুলোর ঝড়-বাতাসে হেলেদুলে নাচানাচি আর সেই সাথে
দু'পাশের অনন্ত জলরাশির উত্তাল মাতামাতি-দাপাদাপিতে নিজেকেই যেন হারিয়ে
ফেললাম এই প্রকৃতির মাঝে ।
সূপর্না আমাকে বলে উঠল, "এই দাড়াও,দাড়াও...এখানেই দাড়াও ।....দেখ,কত
সুন্দর লাগছে !"
আমি মনে মনে ভাবলাম এই প্রকৃতির মাঝে তোমার চেয়ে সুন্দর আর কেউ নেই ।
বিলের মাঝে এই রাস্তাটা মোটামুটি দেড়-দুই কিলো ।এমনিতেই আশ-পাশে কোন বসতি
নেই তার উপর ঝড়ো আবহাওয়ায় কাউকেই চোখে পড়ছে না ।এই নির্জন রাস্তায় শুধু
আমি আর সূপর্না ।
বাইক দাড় করানোর দুই মিনিটের মধ্যে তুমুল বৃষ্টি । সূপর্নার চোখে আরও
বেশী চঞ্চলতা । ও বাধাহীন ঐ উত্তাল তরঙ্গের মতই ছুটাছুটি করছে । আর আমি
অপলক চোখে চেয়ে আছি ওর দিকে ।আচানক ও আমার দিকে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে
ধরল,বুকের মাঝে মুখটা লুকিয়ে হু হু করে কেদে উঠল ।বুঝলাম এত আনন্দ ও
লুকিয়ে রাখতে পারছে না । সেই সাথে মনে হলো এরুপ সুখের মুহূর্ত আর কোনদিন
আসে নি,হয়তবা আসবেও না ।
অঝড়ে বৃষ্টি ঝড়ছে সেই সাথে তুমুল বাতাস ।এই নির্জন পথের মাঝখানে দাড়িয়ে
আছি আমরা দু'জন ।বুকের ভিতর থেকে হৃদয়ের উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়েছে দু'জনার
মাঝে,দু'টি মন হারিয়ে গেল সেদিন শ্রাবনের বৃষ্টিস্নাত বিকেলে ।
অনন্তকাল এভাবেই থাকার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম সেইদিন ।
ও বলেছিল, "পৃথিবীর সব কিছু এনে দিলেও তোমাকে আমি হারাতে চাই না।"
কিন্তু সেই না চাওয়াটাই একদিন চাওয়ায় পরিনত হল ।সূপর্না আজ হয়ত সেদিনের
প্রতীজ্ঞার কথা ভুলে গেছে ।ভুলে গেছে সেদিনের বৃষ্টি ভেজা বিকেল,সন্ধ্যা
।শুধু আমি পারি নি ।তাই বৃষ্টি ভেজা বিকেল এলেই ফিরে যাই সেই শ্রাবনের
বিকেলে । স্মৃতির তিনটি বছর পেছনে ।।
smswopno_nil@ymail.com